নজর কাড়ছে ধান দিয়ে নির্মিত প্রতিমা
সাতক্ষীরার ৫৯৩ মন্ডপে আজ থেকে শুরু শারদীয়া দুর্গোৎসব
ডেক্স নিউজ : বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা জেলার ৫৯৩টি মন্দিরে আজ থেকে শুরু হচ্ছে শারদীয়া দুর্গোৎসব। প্রতি বছরের ন্যায় জেলার বিভিন্ন পূজা মন্ডপে ব্যতিক্রমী কিছু প্রতিমা নির্মিত হলেও এবছর প্রতিমা প্রেমীদের নজর কাড়ছে ধান দিয়ে নির্মিত প্রতিমা। ইতিমধ্যে প্রতিমার সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শেষ করেছেন শিল্পীরা। ভাস্করদের নিপুণ হাতের জাদুর ছোঁয়ায় তৈরি হওয়া দেবী-দুর্গা, গণেশ, কার্তিক ও মহিষাসুরসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা যেন পূর্ণতা পাচ্ছে।
আজ ২৮সেপ্টেম্নর রবিবার মহা-ষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে ৫দিনব্যাপী শারদীয়া দুর্গোৎসব ২অক্টোবর বৃহস্পতিবার শেষ হবে। সাতক্ষীরা জেলার অধিকাংশ মন্দির সেজেছে অপরূপ সাজে। ইতিমধ্যে পূজামন্ডপ গুলো সম্পূর্ণ প্রস্তুত দেবীদূর্গাকে বরণ করতে। ভাস্কররা ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমার সৌন্দর্য বর্ধনের। দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণভাবে সাজাতে গেল ১ মাসের বেশি সময় ধরে মন্দিরগুলোতে দিনরাত বিরামহীন ভাবে চলে ব্যাপক প্রস্তুতি।
সাতক্ষীরা জেলায় শারদীয়া দুর্গাপূজা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিটি পূজামন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া সরকার নির্দেশিত সকল বিধিনিষেধ মেনে এবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এবছর দুর্গোৎসবে যে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। পূজা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ২৪ ঘন্টা জেলা পুলিশের পক্ষ হতে মনিটরিং করা হবে।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে আরও জানা যায়, এ বছর জেলার ৭টি উপজেলায় ৫৯৩টি পূজামন্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। তার মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ১০৭টি, কলারোয়া উপজেলায় ৪৫টি, তালায় ১৯৬টি, আশাশুনি ১০৪টি, দেবহাটায় ২১টি, কালিগঞ্জে ৫০টি ও শ্যামনগরে ৭০টি পূজামন্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন মন্ডপ ঘুরে ও প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি প্রতিমা তৈরি করতে শিল্পীদের সর্বনিম্ন ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয় এবং সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে এ বছর। প্রতিমা তৈরির জন্য তাদের ৩ থেকে ৪ ভ্যান মাটি লাগে, খড়ের বিচলী লাগে ৫ থেকে ৬ পৌনে। এছাড়াও কাঠ, বাঁশ, দড়ি, পেরেক, সুতা ও ধানের গুড়াসহ বিভিন্ন উপকরণের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রতি ভ্যান মাটিতে তাদের খরচ হয় ৬শ’- ৮শ’ টাকা, প্রতি পৌনে বিচলিতে খরচ হয় ৫শ’থেকে ৬শ’ টাকা। আর বাকি জিনিসগুলোর জন্য খরচ হয় ৪-৫ হাজার টাকা। আগের থেকে সব জিনিস পত্রের দাম বেশি হওয়ায় খরচ একটু বেশি হচ্ছে।
তারা আরও জানান, প্রতিটি প্রতিমা তৈরি করতে সময় লাগে গড়ে ১০-১২ দিন। প্রতিমা তৈরিতে ৪-৫জন শিল্পী একসঙ্গে কাজ করেন। একেকজন শিল্পী প্রতিমার এক এক কাজে হাত দেন বলেও জানান প্রতিমা শিল্পীরা। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবছর প্রতিমা তৈরি করতে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হলেও ইতোমধ্যে সব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফয়জুল্যাপুর এলাকার প্রতিমা শিল্পী গুরু ভাস্কর বলেন, ৫০ বছর ধরে প্রতিমা তৈরি করি। এ বছর ৮ টি প্রতিমা তৈরি করছি। বর্তমানে খড়, বাঁশ, মাটি, লোহাসহ সব কিছুর দাম আগের তুলানায় অনেক বেশি। সব কিছুর দাম বেশি হওয়ায় তুলনামূলক ভাবে লাভ কম হচ্ছে।
এবছর দেবীর আগমন ও গমন দুটোই ঘোটকে হওয়ায় অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। শাস্ত্রমতে বলা হয় সপ্তমীতে দেবী দুর্গার আগমন এবং দশমীতে গমন হয়। সাধারণত প্রতি বছর সপ্তমী ও দশমী কী বার পড়ছে তার ওপর নির্ভর করে দেবীর কীসে আগমন ও গমন হয় সেটা বোঝা যায়।
দুর্গোৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনে ব্যস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সব ধর্ম বর্ণ ও শ্রেণি পেশার বাঙালির মধ্যেও। পূজার আনন্দে মাতোয়ারা আজ গোটা বাঙালি জাতি।
মহাপঞ্চমীতে সায়ংকালে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠীতে দুর্গা-দেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা এবং সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, সপ্তমী বিহিত পূজা এবং দেবীর ঘোটকে আগমন। ৩০সেপ্টেম্বর মহাষ্টমীতে দুর্গা দেবীর অষ্টমী বিহিত পূজা।
১অক্টোবর মহানবমীতে বিহিত পূজা এবং ২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীতে বিহিত পূজা সমাপন ও বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও দেবীর ঘটকে গমন হবে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দুর্গোৎসব বিবেচিত হলেও বর্তমানে তা বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ শিল্পীর হাতের নকশায় এবং রং তুলির আঁচড়ের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে দেবী দুর্গার প্রতিমা।
জাতির মঙ্গল কামনায় সব অশুভ শক্তি বিনাশে প্রতিবছর মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা শ্বশুরালয় থেকে পিতৃগৃহে আগমন করেন। আসুরিক শক্তির বিনাশ আর পার্থিব শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে মা দুর্গার আরাধনা করে আসছেন। এদিকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের সহযোগিতায় শারদীয় দুর্গাপূজা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সাতক্ষীরা জেলাবাসী।
সাতক্ষীরা জেলা মন্দির কমিটির সভাপতি বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে তাদের সকল প্রস্তুতি শেষের দিকে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশের সাথে আলোচনা সভা শেষ হয়েছে। তবে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে যে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করলে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না জানানো হয়েছে। এ বছর শারদীয় দুর্গোৎসবকে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিটি পূজামন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি মন্ডপের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ব পালন করবে। জেলার অতিগুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলোর তালিকা করে সেখানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
শারদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তার বিষয়ে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে জেলা পুলিশ সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে আমরা সর্বদা সজাগ রয়েছি। সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ যাতে নির্বিঘেœ তাদের উৎসব পালন করতে পারে সে বিষয়ে সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে র্যাব ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। তাছাড়া এবছর নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটা পূজা মন্ডপ এলাকা সিসি টিভির আওতায় থাকবে বলে জানা গেছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। জেলায় এবছর ৫৯৩ টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। শারদীয় দুর্গাপূজা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিটি পূজা মন্ডপকে বাধ্যতামূলক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে এবং যে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।

No comments